বাঙালির ক্ষমতালিপ্সা ও প্রতারণা: বাংলা বিভাজনের এক অনালোচিত অধ্যায়
এই ব্লগে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় বাংলার স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া নিয়ে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা কিভাবে ক্ষমতালিপ্সা, প্রতারণা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে নস্যাৎ হয়ে গেল, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার বিভক্তির কারণ ও পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে।
BLOG
ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ভারতীয় উপমহাদেশকে তিনটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসে সাধারণত ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম নিয়েই আলোচনা হয়, কিন্তু পূর্ব বাংলার বাঙালিরা কিভাবে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের সম্ভাবনা হারাল, তা নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচনা হয়। কিছু বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতালিপ্সা, কৌশলী প্রতারণা, এবং ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে উপমহাদেশ দুই ভাগে বিভক্ত হলো, যেখানে তৃতীয় রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল। এই প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে, ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ব্রিটিশ প্রশাসনের কৌশল, এবং ভারত ও পাকিস্তানের আর্থসামাজিক স্বার্থের দিকগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।
১৯৪৬ সালে যখন ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ‘তিন রাষ্ট্রের’ ধারণাটি খুব একটা অবাস্তব ছিল না। বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক গঠন অনুযায়ী, হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলা ও মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলা ভিন্ন পথ বেছে নিতে পারত। এমনকি মুসলিম লীগের কিছু নেতার মধ্যে পূর্ব বাংলাকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র করার চিন্তাভাবনাও ছিল। কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই এবং ব্রিটিশদের কৌশলী নীতি এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত হতে দিল না।
রাজনৈতিকভাবে বাংলার বিভাজনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল মুসলিম লীগের ভেতরের বিভক্তি। জিন্নাহ ও পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ নেতারা চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে, যাতে তাদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের ধারণা সফল হয়। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলার কিছু রাজনৈতিক নেতা, বিশেষ করে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, এই ধারণাকে বাস্তবায়ন করতে হলে অনেক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতো, যা সেই সময়ের ক্ষমতালিপ্সু নেতারা চাননি।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলার স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কারণ পূর্ব বাংলা কৃষিভিত্তিক হলেও এটি ছিল খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর, এবং শস্য ও পাট উৎপাদনের কারণে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলার সক্ষমতা রাখত। তবে ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং পাকিস্তানের জিন্নাহ উভয়েই চেয়েছিলেন বাংলার সম্পদ নিজেদের দখলে রাখতে। বিশেষ করে কলকাতা ছিল সমগ্র বাংলার শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু, এবং এটি পশ্চিম বাংলার সঙ্গে থাকার ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানও চেয়েছিল পূর্ব বাংলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কারণ এটি ছাড়া পাকিস্তানের অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে যেত। ফলে অর্থনৈতিক স্বার্থে বাংলার স্বাধীনতার সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হলো।
তবে বাংলার বিভাজনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল কূটনৈতিক প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র। ব্রিটিশরা সবসময় চেয়েছিল ভারতকে বিভক্ত করে রাখতে, যাতে তাদের উপনিবেশ-পরবর্তী স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে। তারা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকে ইন্ধন দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে সহায়তা করে। কিন্তু যখন বাংলা ভাগের প্রসঙ্গ এল, তখন ব্রিটিশরা কৌশলে এটিকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ভাগ করে দেয়, কারণ তারা জানত যে একক স্বাধীন বাংলার অস্তিত্ব তাদের কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী হবে। মুসলিম লীগের নেতৃত্বও বুঝতে পেরেছিল, একটি স্বতন্ত্র বাংলা হলে তা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই জিন্নাহ ও তাঁর অনুসারীরা পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের বিভক্ত করলেন এবং তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করলেন।
আরেকটি বড় কারণ ছিল বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। বাঙালি মুসলিম নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং নিজেদের স্বার্থের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার ফলে বাংলার স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়। অনেক নেতা ব্যক্তিগত ক্ষমতা অর্জনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন, ফলে তারা বৃহত্তর স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে ব্যর্থ হন। সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখলেও মুসলিম লীগের ভেতরের অন্য শক্তিগুলো পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং তাদের প্রস্তাব ব্যর্থ করে দেয়।
এই প্রতারণার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল ছিল ভয়াবহ। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হলেও এটি পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা শোষিত হতে থাকে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমাগত সংঘাত সৃষ্টি হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, যদি বাংলার তৎকালীন নেতারা তাদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটি স্বাধীন বাংলার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে পারতেন, তাহলে ১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে পারত এবং ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রয়োজন হতো না।
এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। ক্ষমতালিপ্সা ও প্রতারণার ফলে কিভাবে একটি সম্ভাব্য স্বাধীন রাষ্ট্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তার বড় উদাহরণ হলো ১৯৪৭ সালের বাংলার ভাগ। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ যখন জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যায়, তখন একটি জাতির ভবিষ্যৎ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে। এজন্য ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই ঐক্য, ন্যায়বিচার, এবং দূরদর্শী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে আর কখনো বাংলার ভাগ্যের সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা না হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ইতিহাসের এক পরম শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না!
আরও পড়ুনঃ রুয়ান্ডা : গণহত্যার বিভীষিকা থেকে উন্নয়নের রোল মডেল