ইসলামের দৃষ্টিতে রিজিক
এই ব্লগে ইসলামের দৃষ্টিতে রিজিকের সংজ্ঞা এবং তার গুরুত্ব আল কোরআনের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রিজিক কেবল আর্থিক সম্পদ নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জীবনের সকল প্রয়োজনীয়তা—খাদ্য, স্বাস্থ্য, সুখ এবং আত্মিক উন্নতির প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামে রিজিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা, আস্থা এবং সামাজিক দায়িত্বের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে।
BLOG
ইসলামের দৃষ্টিতে রিজিক এমন একটি ধারণা, যা মানুষের জীবনে উপকারিতা, উন্নতি এবং উন্নত জীবনধারণের সাথে সম্পর্কিত। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া সেইসব অনুগ্রহ যা মানুষের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে, যেমন খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান, পোশাক এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা। রিজিক কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বা সম্পদের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং মানুষের প্রতিটি আঙ্গিকে—শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক দিক থেকেও আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামে রিজিকের ব্যাপারে আল কোরআনে বিভিন্ন জায়গায় আলোচন করা হয়েছে, যা মুসলমানদেরকে তাদের জীবনে একে একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
আল কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, "আল্লাহই যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি যা কিছু আমাদের জন্য তৈরি করেছেন, তা আমাদের জন্য রিজিক হিসেবে প্রদান করেছেন" (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২৬০)। এই আয়াতে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, রিজিক বা জীবনের উপকরণ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক অমূল্য অনুগ্রহ। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি রিজিক প্রদান করেন এবং এটিই মানুষের জন্য সত্যিকারের জীবিকা। এই রিজিকের মধ্যে রয়েছে শুধু ধনসম্পদ নয়, বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুখ, শান্তি এবং ভালোবাসাও অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে এসবকে রিজিকের আওতায় রাখা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আরেকটি আয়াতে বলেন, "তোমরা যা খেতে এবং পান করতে, তা সব আল্লাহর দেওয়া রিজিক" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৬৫)। এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝানো হচ্ছে যে, মানুষের প্রতিটি চাহিদা, যে এটি খাদ্য বা পানীয় হোক, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অনুগ্রহ। যেকোনো আঙ্গিকে যা কিছু জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এর মাধ্যমে মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যে কোনো জিনিসের প্রতি তীব্র আশা বা লোভ করা উচিত নয়, কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নির্ধারিত তা অবশ্যই মানুষের জন্য যথেষ্ট এবং যথাযথ হবে।
এছাড়া, কোরআনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, "আমিই রিজিকের ব্যবস্থা করি এবং তোমরা তা যা চাও, তা গ্রহণ করো" (সূরা আত্-তাওবা, আয়াত ৭৬)। এই আয়াতে আল্লাহ মানুষের কর্মের প্রতি তাঁর রাজি থাকা বা না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বান্দার কাজের ফলস্বরূপ রিজিক প্রদান করেন, তবে এখানে একটি মৌলিক শিক্ষা নিহিত রয়েছে, তা হলো—আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে, মানুষের উচিত তার চেষ্টা এবং পরিশ্রম করা, তবে আল্লাহর ইচ্ছার উপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া। এখানে এটি স্পষ্ট যে, মানুষ যতটুকু কামনা করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত রিজিকের পরিমাণ আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
ইসলামের দৃষ্টিতে রিজিকের ধারণা আরও বিস্তৃত। এটা শুধুমাত্র উপার্জন বা অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মধ্যে রয়েছে অন্যদের সেবা করা, সমাজে ভাল কাজ করা, এবং আত্মার উন্নতি করা। কোরআনে বলা হয়েছে, "যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে তার সম্পদ ব্যয় করবে, সে ব্যক্তি কেবল নিজের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য উপকারী হবে" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৬৪)। এখানে রিজিকের সামাজিক দিকটি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর দেওয়া রিজিকের একাংশ সমাজে সঠিকভাবে বিতরণ করা উচিত এবং এটা কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, বরং সামাজিক কল্যাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রিজিকের অবস্থা কখনো একে অপরের মধ্যে সমান হয় না। আল্লাহ তাআলা যেভাবে তাঁর বান্দাদের মাঝে রিজিক বণ্টন করেন, তা বিভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে। কিছু মানুষের রিজিক প্রচুর, কিছু মানুষের কম। তবে ইসলাম ধর্মে কোনো একজনকে ঈর্ষা বা হিংসা করা, বিশেষ করে অন্যের রিজিক দেখে, নিষিদ্ধ। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "তোমরা যা পেয়েছো, তা গ্রহণ করো এবং যাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে তাদের ঈর্ষা করো না" (সূরা আল-হাদিদ, আয়াত ১৫)। এখানেই প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী ব্যক্তির রিজিকের প্রতি একটা ইতিবাচক মনোভাব রাখা হয়েছে। এতে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে যে, রিজিকের পরিমাণে পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তা কখনও অন্যদের ক্ষতি করতে বা ঈর্ষা জন্মাতে পারে না।
রিজিকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার উপকারীতা। আল্লাহ তাআলা যে রিজিক প্রদান করেন, তা সবসময় মানুষের কল্যাণের জন্য উপযুক্ত এবং যথার্থ হয়। কোরআনে রয়েছে, "যে আল্লাহ তার বান্দাকে যা দান করেন, তা সর্বোত্তম এবং সঠিক সময়েই প্রদান করা হয়" (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১০৫)। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হলো, যে কোনো ধরনের রিজিক যা মানুষের হাতে আসে, তা কখনো অনির্বাচিত বা অনির্দিষ্ট হয় না। আল্লাহ বান্দার জন্য যে রিজিক নির্বাচন করেন তা তার জীবনের সঠিক সময় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে রিজিকের রহস্য বোঝা সহজ নয়, কারণ তা আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তবে মুসলমানদের জন্য রিজিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঈমান শক্তিশালী করতে কোরআন ও হাদিসের আলোকে যা বলা হয়েছে, তা হলো—মানুষ যেন কখনও তার রিজিকের প্রতি আস্থাহীন না হয় এবং সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের যা কিছু দেন, তা সঠিক এবং যথার্থভাবে দেয়। এর মাধ্যমে ইসলামে রিজিকের একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ হতাশার অন্ধকারে আল কোরআনের আলো