গণতন্ত্রের পথ হারিয়ে ফের স্বৈরশাসনের ছায়ায় মিশর

আরব বসন্তের পর মিশর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করলেও, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই গণতন্ত্র হারিয়ে যায়। সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের ফলে দেশটি আবারও কঠোর শাসনের অধীনে ফিরে আসে। এই ব্লগে আলোচনা করা হয়েছে মিশরের গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার কারণ, সামরিক বাহিনীর উত্থান, এবং কীভাবে দেশটি আবারও স্বৈরশাসনের ছায়ায় ঢেকে গেছে।

BLOG

মোঃ ইমরান আহম্মেদ

2/10/20251 মিনিট পড়ুন

five persons riding camels walking on sand beside Pyramid of Egypt
five persons riding camels walking on sand beside Pyramid of Egypt

আরব বসন্ত যখন ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, তখন মিশরের জনগণও দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছিল। সামরিক বাহিনীর চাপে মোবারক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন, এবং এরপর মিশর প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার পায়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই গণতন্ত্র আবারও হারিয়ে যায়, এবং দেশটি স্বৈরশাসনের এক নতুন রূপের অধীনে ফিরে আসে। কী এমন ঘটেছিল যে, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়ে আবার সামরিক শাসনের কবলে পড়ে দেশটি?

গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম পরীক্ষা হিসেবে মিশরের জনগণ ২০১২ সালের নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু তার শাসনামলে গভীর বিভাজন, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বিরোধী দলের দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠে। পশ্চিমা গণতন্ত্রে পরিপক্বতার অভাব এবং ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা মুরসির সরকারকে নড়বড়ে করে তোলে। তার শাসনে ইসলামপন্থীদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ নিয়ে জনগণের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।

এদিকে, দেশের অর্থনীতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। বিনিয়োগ কমছিল, পর্যটন শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ছিল, এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুরসির শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের হতাশা বাড়ছিল, যা বিরোধীদের সুযোগ করে দেয় নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলতে। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয়, এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০১৩ সালে মিশরের সামরিক বাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। সামরিক বাহিনীর প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি তখন দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তার শাসন আরও কঠোর দমনমূলক হয়ে ওঠে।

সিসির ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, এবং বিরোধী কণ্ঠগুলো দমন করা হয়। গণতন্ত্রের নামে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে সেনাবাহিনীই মূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০১৪ সালে এক নির্বাচনের মাধ্যমে সিসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হন, তবে সে নির্বাচন ছিল ব্যাপক অনিয়ম কারচুপির অভিযোগে কলঙ্কিত। গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে বিরোধীদের জন্য আর কোনো স্থান অবশিষ্ট থাকে না।

মিশরের গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব এবং সংবিধানগত কাঠামোর দুর্বলতা। গণতন্ত্র কেবলমাত্র নির্বাচনভিত্তিক একটি ব্যবস্থা নয়; বরং এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, এবং জনগণের অধিকার সংরক্ষণের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মুরসির সরকার দিকগুলোতে ব্যর্থ হয়েছিল, এবং সেই শূন্যস্থান সামরিক বাহিনী পূরণ করতে এগিয়ে আসে। জনগণের একাংশ সামরিক বাহিনীর এই হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানালেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি মিশরের গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।

আরেকটি বড় ভুল ছিল ইসলামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস। মুসলিম ব্রাদারহুড নিজেদের আদর্শ বাস্তবায়নে তাড়াহুড়ো করেছিল, যা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছিল। এই বিভাজনের ফলে একটি ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে ওঠেনি, যা সামরিক বাহিনীর পক্ষে সুবিধাজনক ছিল। সামরিক বাহিনী দক্ষতার সাথে এই বিভক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে নেয়।

আজকের মিশর আবারও একটি কঠোর স্বৈরশাসনের অধীনে রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতার অভাব, এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি দমন-পীড়ন এখন দেশটির বাস্তবতা। গণমাধ্যম সেন্সরশিপের অধীনে, এবং সামান্যতম ভিন্নমতও কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। মিশরের এই বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার জন্য রাজনৈতিক পরিপক্বতা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, এবং আইনশৃঙ্খলার ভারসাম্য অপরিহার্য। মিশরের অভিজ্ঞতা থেকে এটি গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা যে, গণতন্ত্র রক্ষা করা সহজ নয়, এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত না করলে তা সহজেই স্বৈরতন্ত্রে রূপ নিতে পারে।

আরও পড়ুনঃ যেসব ভুলে তিউনিশিয়ায় স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসছে