যেসব ভুলে তিউনিশিয়ায় স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসছে
তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা আরব বসন্তের অন্যতম সফল বিপ্লব হিসেবে প্রশংসিত হলেও, দেশটি কেন গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো? রাজনৈতিক বিভক্তি, অর্থনৈতিক সংকট, নিরাপত্তা হুমকি, ও বৈদেশিক প্রভাব কীভাবে গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই নিবন্ধে। তিউনিশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়, তা জানতে পড়ুন এই গভীর বিশ্লেষণ।
BLOG
আরব বসন্তের অন্যতম সফল বিপ্লব হিসেবে তিউনিশিয়ার নাম উচ্চারিত হলেও দেশটি কেন স্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে, তা বিশ্লেষণের জন্য ইতিহাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, ও সামাজিক বিভাজনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। ২০১১ সালে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট জিন আল-আবিদিন বেন আলির পতনের পর তিউনিশিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা গিয়েছিল। তবে এক দশকেরও বেশি সময় পর দেশটি আবার স্বৈরতন্ত্রের দিকে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এই ব্যর্থতার পেছনে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের মতো বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রধান বাধাগুলোর একটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিভক্তি ও স্থিতিশীলতার অভাব। বিপ্লবের পর সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলেও, দেশটি ক্রমাগত রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে, যা সরকারকে কার্যকরভাবে কাজ করতে বাধা দেয়। বিশেষ করে, এননাহদা পার্টির রাজনৈতিক ভূমিকা ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সংঘাত বারবার সরকারের পতনের কারণ হয়েছে। ফলে, নির্বাচিত সরকারগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি এবং বারবার মন্ত্রীসভার রদবদল ও অস্থায়ী সরকার গঠনের ফলে শাসন কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক সংকট তিউনিশিয়ার গণতন্ত্রের টিকে থাকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব বসন্তের পর দেশটি উচ্চ বেকারত্ব, কম বিনিয়োগ এবং আর্থিক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছে। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা জনসাধারণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। বিপ্লবের পর সরকারগুলো জনগণের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায়, তারা দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অব্যাহত মূল্যস্ফীতি, সরকারি ঋণের বোঝা, এবং দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করেছে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও গভীর করেছে।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংবিধান রচনার সময় একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ার প্রচেষ্টা থাকলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ত্রুটি রয়ে গেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়নি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে কার্যকর সংযোগ তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপোষহীন মনোভাব এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা গণতান্ত্রিক শাসনকে দুর্বল করেছে। ফলস্বরূপ, প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ ২০২১ সালে পার্লামেন্ট স্থগিত করেন এবং এককভাবে শাসন চালাতে শুরু করেন, যা কার্যত স্বৈরতন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটায়।
তিউনিশিয়ার গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা সংকট ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান। আরব বসন্তের পরে, বিশেষ করে ২০১৫-১৬ সালে, দেশটিতে একাধিক বড় সন্ত্রাসী হামলা ঘটে, যা পর্যটন খাত ও সামগ্রিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং সরকারকে কঠোর নিরাপত্তা নীতির দিকে ঠেলে দেয়। একপর্যায়ে, নিরাপত্তার অজুহাতে সরকার নাগরিক অধিকার সীমিত করতে শুরু করে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতি ঘটায়। রাষ্ট্রের কঠোর দমননীতি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করলেও, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলো এটিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
বৈদেশিক শক্তির ভূমিকাও তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার ক্ষেত্রে বিবেচ্য। বিপ্লবের পর দেশটি পশ্চিমা বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গণতন্ত্রকে সমর্থন করলেও, তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা স্বল্পমেয়াদী ছিল। অন্যদিকে, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে এবং প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদের একনায়কতন্ত্রের প্রতি নীরব সমর্থন দিয়েছে। ফলে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বৈদেশিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সামাজিক বিভাজন ও বিক্ষোভের ধারাবাহিকতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লবের পর আশানুরূপ পরিবর্তন না আসায় জনগণের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ ও শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য, সামাজিক সুরক্ষার অভাব, এবং নাগরিক অধিকার সংকোচনের কারণে জনগণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। একাধিকবার বিক্ষোভ ও ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছে, যা অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়শই দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা গণতন্ত্রকে আরও দুর্বল করেছে।
তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা থেকে বোঝা যায় যে শুধু স্বৈরশাসকের পতন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। দেশটির অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে গণতন্ত্র কেবল একটি প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা যার জন্য রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও কার্যকর প্রশাসন দরকার। তিউনিশিয়া যদি ভবিষ্যতে সত্যিকারের গণতন্ত্র চায়, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, আইনগত সংস্কার, ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায়, দেশটি আবারও স্বৈরতন্ত্রের গহ্বরে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
আরও পড়ুনঃ আল কোরআনের শিক্ষা: জুলুমকারীদের প্রতি কঠোর বিধান ও শাস্তি