বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে চীনের উত্থানের নেপথ্যের গল্প

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে স্বল্পসময়ে বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষে উঠে এলো? এই বিশ্লেষণমূলক লেখায় সরকারের সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ, গবেষণায় অগ্রাধিকার, প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিকীকরণের কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চীনের সাফল্য কীভাবে অন্যান্য দেশগুলোর জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে, তা জানতেও পড়ুন এই গভীরতাপূর্ণ বিশ্লেষণ।

BLOG

মোঃ ইমরান আহম্মেদ

2/12/20251 মিনিট পড়ুন

a chinese flag hanging from the side of a building
a chinese flag hanging from the side of a building

বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে চীনের উত্থান সাম্প্রতিক বছরগুলোর অন্যতম আলোচিত বিষয়। মাত্র দুই দশকের মধ্যে চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। পূর্বে যেখানে শুধুমাত্র পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই শীর্ষে থাকত, এখন সেখানে চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শক্তিশালী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সাফল্যের পেছনে চীনের সুপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষানীতি, গবেষণা প্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ, এবং গ্লোবালাইজেশনের কৌশলগত ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

চীনের এই উন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সরকার কর্তৃক উচ্চশিক্ষায় সরাসরি বিপুল বিনিয়োগ। ১৯৯৮ সালে গৃহীত "৯৮৫ প্রকল্প" এবং পরবর্তী সময়ে "২১১ প্রকল্প" উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে চীনের সরকার উচ্চমানের গবেষণার জন্য বিশাল পরিমাণ অর্থায়ন করেছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে। বিশেষ করে, "ডাবল ফার্স্ট-ক্লাস ইনিশিয়েটিভ" কার্যক্রম চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা শিক্ষাদানের লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।

গবেষণা উদ্ভাবনে বিনিয়োগের দিক থেকে চীন বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার সংখ্যা, গবেষণা অনুদান, এবং পেটেন্ট আবিষ্কারের পরিমাণে চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ২০২০ সালের পর থেকে চীন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে। ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না (USTC), চিংহুয়া ইউনিভার্সিটি, এবং পেকিং ইউনিভার্সিটি বিশেষভাবে কৃতিত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য স্বীকৃত হয়েছে। ফলে, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত জার্নালগুলোতে চীনের গবেষকদের উপস্থিতি বেড়েছে, যা র‍্যাংকিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য চীন কৌশলগতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক গবেষকদের আকৃষ্ট করতে দেশটি উচ্চ বেতনের সুবিধা গবেষণার জন্য উন্নত পরিকাঠামো তৈরি করেছে। এছাড়া, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে। চীন সরকার "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ" (BRI)-এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করেছে, যা চীনের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈশ্বিকভাবে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে চীন আধুনিক প্রযুক্তি ডিজিটাল শিক্ষার ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, এবং ব্লকচেইনের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর গবেষণার পাশাপাশি পাঠদানের ক্ষেত্রেও এসব প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষত, চিংহুয়া ইউনিভার্সিটি এবং ফুদান ইউনিভার্সিটি উদ্ভাবনী প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ফলে, শিক্ষার্থীদের গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নত হয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি চীন তার উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকীকরণে মনোযোগী হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম, এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজনের মাধ্যমে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, এমআইটি, এবং স্ট্যানফোর্ডসহ বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে চীনের গবেষণা সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা র‍্যাংকিং বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।

শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে চীন বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু একাডেমিক শিক্ষার ওপর নির্ভর না করে, দেশটি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ বাস্তবজ্ঞান অর্জনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্ডাস্ট্রি-লিঙ্কড গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে, শিক্ষার্থীরা স্নাতক হওয়ার পরপরই চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে চলে আসছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনাম বৃদ্ধি করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে চীনের এই দ্রুত অগ্রগতির আরেকটি কারণ হচ্ছে সরকার শিক্ষাবিদদের দূরদর্শী পরিকল্পনা। উচ্চশিক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান, এবং শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার ফলে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বল্পসময়ে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে, চীনের এই উচ্চশিক্ষা নীতি গবেষণা সহযোগিতা দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানকে বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও সুসংহত করেছে।

চীনের এই অভূতপূর্ব সাফল্য অন্য দেশগুলোর জন্য একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু অর্থায়ন নয়, বরং সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণার প্রতি অঙ্গীকার, প্রযুক্তির উন্নয়ন, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, সরকারের সুদূরপ্রসারী নীতি এবং একাডেমিক উৎকর্ষ সাধনের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে দ্রুত অগ্রগতি সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ বাঙালির ক্ষমতালিপ্সা ও প্রতারণা: বাংলা বিভাজনের এক অনালোচিত অধ্যায়